পদ্মার ইলিশ চেনার উপায় কি?
মাছে-ভাতে বাঙালির অন্যতম প্রিয় খাদ্য হলো মাছ। আর এই মাছের মধ্যে ইলিশ মাছ হলো বাঙলির সবচেয়ে প্রিয় খাদ্য। শুধু জাতীয় মাছ বলেই নয়, স্বাদে ও পুষ্টিগুণে ইলিশ অনন্য। এই মাছের স্বাদ অতুলনীয়। শুধু স্বাদই নয় পুষ্টিতেও এই মাছের রয়েছে অনেক অবদান। মানুষের পুষ্টির অনেকটা চাহিদাই পূরণ করে এই মাছ। এই মাছ বাঙালির সংস্কৃতির একটি অন্যতম অংশ।
Contents
ইলিশ মাছের পুষ্টিগুণ:
ইলিশ বাঙালির সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। শুধু সাংস্কৃতিক বা ঐতিহ্যগত কারণেই এর কদর এমন কিন্তু নয়। পুষ্টির চাহিদা অভাব পূরণের জন্যও এর প্রচুর চাহিদা রয়েছে। এই মাছে রয়েছে বিভিন্ন পুষ্টিকর উপাদান। একপ্রকার পরিপূর্ণ একটি খাদ্যই বলা চলে এই মাছকে। আসুন জেনে নিই এর পুষ্টিগুণ বা পুষ্টি উপাদান।
- মস্তিষ্কের জন্য উপকারী ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড রয়েছে এই মাছে। এই ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড আবার চোখের জন্যও উপকারী।
- প্রচুর পরিমাণে তেল রয়েছে এই মাছে। কিন্তু এই তেল ক্ষতিকর নয় বরং উপকার করে এই তেল। এই তেল দেহের নার্ভ সিস্টেমকে শক্তিশালী করে তোলে। এছাড়াও দেহের রক্ত সঞ্চালন বাড়ায় এবং হৃৎপিন্ডের ক্ষতিকর কোলেস্টেরল বের করে দেয় এই তেল।
- ভিটামিন ডি জাতীয় খাদ্য দেহের ত্বক ও চুলের জন্য ভালো। আর এই ভিটামিন ডি এর অভাবে পূরণে ইলিশ মাছ কার্যকর।
- রক্তের কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ রাখার পাশাপাশি দেহের বিভিন্ন ব্যথা কমাতেও এই মাছ সাহায্য করে।
- এছাড়াও ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড স্মৃতিশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে এবং বিষন্নতাও দূর করে।
- হৃৎপিন্ডকে সুস্থ রাখে এই মাছ।
কোন ইলিশের স্বাদ বেশি?
ইলিশ মাছ স্বাদে অনন্য। কিন্তু সব ইলিশের স্বাদ কিন্তু সমান নয়। ইলিশ মাছের স্বাদ কেমন হবে সেটা তার সাইজের উপরও নির্ভর করে। যে ইলিশ যত বড় তার স্বাদ তত বেশি।
এছাড়া সমুদ্র থেকে ইলিশ যখন উজানে বা নদীতে ঢুকে তখন স্রোতের বিপরীতে চলার কারণে ইলিশের দেহে অনেক চর্বি জমা হয়। আর এই তেল বা চর্বির জন্য ইলিশের স্বাদ বেড়ে যায় বহুগুণ। অর্থাৎ, তেলের ইলিশের স্বাদ বেশি।
তাছাড়া বর্ষাকালে ইলিশের স্বাদ বেড়ে যায়। সমুদ্রের পানি নোনা হওয়ার সমুদ্রের চেয়ে নদীর ইলিশের স্বাদই বেশি। এছাড়াও ডিম ছাড়া ইলিশের স্বাদ ডিমওয়ালা ইলিশের চেয়ে তুলনামূলক বেশি হয়। কেননা ডিম ছাড়ার পর বা পেটে ডিম থাকলে ইলিশের দেহের চর্বি কমে যায়। ফলে এর স্বাদও কমে যায়। তাই ইলিশ কেনার আগে দেখে নেওয়া ভালো মাছের পেটে ডিম আছে কি না বা মাছ সদ্যই ডিম ছেড়ে এসেছে কি না।
পদ্মার ইলিশ কেন এত বিখ্যাত?
পুরো পৃথিবীর অসংখ্য ইলিশের সিংহভাগই হয় বাংলাদেশে। অর্থাৎ, ইলিশের মূল আবাসস্থলই হলো বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ইলিশের মধ্যে আবার পদ্মার ইলিশ বিখ্যাত। পদ্মার ইলিশের সুনাম দুনিয়া জুড়েই রয়েছে। কিন্তু কেন এত বিখ্যাত পদ্মার ইলিশ?
মূলত পদ্মার ইলিশ যে ধরনের খাবার খায় বা স্রোতের বিপরীতে থাকার কারণে এদের শরীরে যে পরিমাণ চর্বি জমা হয় তা এর স্বাদ বাড়ানোর মূল অনুষঙ্গ। পদ্মার ইলিশের দেহে জমা হওয়া এই তেলই পদ্মার ইলিশকে বিখ্যাত করার মূল কারণ। এই তেলের কারণেই এর স্বাদ অনেক বেড়ে যায়।
পদ্মার ইলিশ চেনার উপায়:
ইলিশের নাম শুনলেই বাঙালির মনে পদ্মার ইলিশ ভেসে উঠে। সামুদ্রিক কিংবা অন্য নদী যেমন: মেঘনাতেও ইলিশ পাওয়া গেলেও বাঙালির যেনো পদ্মার ইলিশই চাই। স্বাদে-গন্ধে ইলিশের আসলে রূপের দেখা মূলত পদ্মার ইলিশেই দেখা যায়। কিন্তু এই পদ্মার ইলিশ চেনার উপায় কি? কিভাবে চেনা যাবে পদ্মার ইলিশ?
পদ্মার ইলিশ আকার হবে অনেকটা পটলের মতো অর্থাৎ পেট মোটা হবে আর মাথা ও লেজ হবে সরু। আকারে হবে একটু ছোট বা খাট। লেজের ওপর থেকেই মাছটা গোল হতে শুরু করবে। অন্য নদীর তুলনায় পদ্মার ইলিশ দেখতে রূপালী ও উজ্জ্বল হয়। ইলিশ আসলে সারা বছর সাগরেই থাকে কিন্তু ডিম পাড়ার সময় নদীতে আসে। এছাড়াও নদীর মাছের আকার কিছুটা ভিন্ন হয় সাগরের মাছ থেকে। নদীর মাছের মাথা সরু ও পেট মোটা হয়।
তবে মূলত স্বাদ ও গন্ধ দ্বারাই পদ্মার ইলিশ চেনা যায়।
ডিম ওয়ালা আর ডিম ছাড়া ইলিশ চেনার উপায়
ইলিশের স্বাদ বাড়া বা কমার অন্যতম একটি কারণ ভাবা হয় ইলিশের ডিমকে। ইলিশের পেটে ডিম থাকলে কিংবা সদ্যই ডিম ছেড়ে আসা ইলিশ খেতে অতটা সুস্বাদু হয় না। ডিম ছাড়া ইলিশই খেতে বেশি মজা। তা ইলিশ ডিমওয়ালা নাকি ডিম ছাড়া তা বোঝার কি কোনো উপায় আছে?
ডিমওয়ালা ইলিশ মূলত পেট মোটা হয়। আকারেও এরা চ্যাপ্টা হয়। ডিমওয়ালা ইলিশের পেটে চাপ দিলেই পায়ুপথে ডিম বের হয়ে আসে। এ থেকেই বোঝা যায় ইলিশ ডিমসহ নাকি ডিম ছাড়া। এছাড়াও ডিম ছাড়া যেসব ইলিশ হয় তাদের পেট আলগা হয় বা ঢিলা হয়।
ইলিশের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
ইলিশের মাছ চোখের সামনে থাকলে লোভ সামলাতে পারেন এমন বাঙালি খুব কমই আছেন। সামনে থাকা লাগে না, শুধু গন্ধেই এর থেকে দূরে থাকা দায়। এত সুস্বাদু খাবার, তার উপর অনেক পুষ্টিগুণ থাকা আমাদের এই জাতীয় মাছেরও আছে কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। যদিও এই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সবার ক্ষেত্রে সমান নয়।
- ক) এলার্জি
সবচেয়ে বড় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্ভবত এলার্জি। এলার্জি প্রবণ একটি মাছ হওয়ায় যাদের এলার্জির সমস্যা আছে তাদের এই মাছ না খাওয়াই ভালো। কারণ এলার্জি থেকে অনেক সময় বড় ধরনের সমস্যা হতে পারে।
- খ) অতিরিক্ত কাঁটা
এছাড়াও ইলিশ মাছে কাঁটার পরিমাণ অত্যাধিক। তাই এই মাছ খাওয়ার সময় কাঁটা লেগে যাওয়ার ভয় থাকে। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এই ভয় আরো বেশি কাজ করে। তাই এই মাছ খাওয়ার সময় সতর্কতা অবলম্বন করা উচিৎ। কারণ গলায় কাঁটা বিঁধলে তা থেকে অসহ্য যন্ত্রণা হতে পারে।
- গ) বিষক্রিয়া হওয়ার সম্ভাবনা
তাছাড়াও আরেকটি তথ্য হল, ভারতীয় এক সাম্প্রতিক গবেষণার মতে, বেশি পরিমাণে ইলিশ খেলে দেহে বিষক্রিয়া হতে পারে। অবশ্য তাদের মতে, এই বিষক্রিয়ার ধরণ অনেকটা এলার্জির মতোই হবে। ইলিশে বেশি পরিমাণে হিস্টিডিন নামে এক প্রকার অ্যামাইনো এসিড বেশি পরিমাণে থাকায় এই সমস্যা হতে পারে। গবেষণার তথ্য মতে শুধু ইলিশ নয় আরো অনেক সামুদ্রিক মাছ থেকেই এ সমস্যা হতে পারে।
কোন ইলিশ কেনা উচিৎ নয়?
ইলিশ বিখ্যাত এর স্বাদ ও গন্ধের জন্য। তাহলে কি সব ইলিশই এক? না। জাটকা ইলিশ বা ইলিশের বাচ্চা কেনা উচিৎ নয়। কারণ জাটকা ইলিশের স্বাদ থাকে না তেমন আর এদের মধ্যে ইলিশের গন্ধও তেমন নেই।
এছাড়াও জাটকা ইলিশ ক্রয় বা ধরা আইনত অপরাধ। কারণ বাচ্চা ইলিশ বা জাটকা ইলিশ ধরে ফেললে সেগুলো আর বড় হওয়ার সুযোগ পায় না। এতে দিনশেষে আমরাই ভালো মানের বড় ইলিশ খাওয়া থেকে বঞ্চিত হই পাশাপাশি ইলিশের বংশবৃদ্ধিও ব্যাহত হয়।
পরিশেষে –
ইলিশ বাঙালির জীবনে ওতপ্রোতভাবে জড়িত একটি মাছ। এটি এমনি এমনি আমাদের জাতীয় মাছ নয়। স্বাদে, গন্ধে অতুলনীয় এই মাছ আমাদের অর্থনীতিরও একটি বড় অনুষঙ্গ। এই মাছের পুষ্টিগুণ অনেক হওয়ায় এর উপকারিতাও প্রচুর। অনেক পুষ্টির অভাবে একসাথে পূরণে সক্ষম এই মাছ।
সুস্বাদু এই মাছের চাহিদা দেশে দিন দিন বেড়েই চলেছে। তবে আকাশচুম্বী দামের কারণে অনেকেই এই মাছ কিনতে পারেন না। তাই জাটকা ধরা বন্ধ করে এই মাছকে বেড়ে উঠার সুযোগ দেওয়া উচিৎ। তাতে দেশের চাহিদা পূরণ করতে অনেকটাই সক্ষম হবে এই মাছ।
২০১৭ সালে বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া ইলিশ রপ্তানী করে বাংলাদেশের আয় বাড়ার সম্ভাবনা দিন দিন বেড়েই চলেছে। তাই এর যত্ন নেওয়া ও একে স্বাধীনভাবে বাড়তে দেওয়া সকলেরই দায়িত্ব।
Source: sasthobidhi.com